শায়খুত তরিক্বত হাফেজ হামেদ হাসান আলভী আজমগড়ী রহ.’র জীবন ও কর্ম

লেখকঃ কাউছার উদ্দীন মালেকী
  • Update Time : বুধবার, ২২ মার্চ, ২০২৩
  • ৩৫৭ Time View

অবিভক্ত বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশের তরিক্বত জগতের এক দীপ্তিমান আলোকবর্তিকা হচ্ছেন, শায়খুত তরিক্বত আলহাজ্ব হাফেজ হামেদ হাসান আজমগড়ী রহ.। যাঁর তরীক্বতের প্রচার-প্রসার আজ সারা বিশ্বব্যাপী। পীরতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনকারী এ মহান মনীষী ভারতের আজমগড় জেলার কোহন্ডায়; চিশতিয়া তরীক্বার পীর হজরত আবু হামেদ মিয়া করিম বখশ্ রহ.’র ঘরে ১৮৭১/৭২ খ্রিস্টাব্দে ১২৭৮/৭৯ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তৎকালীন সময়ে বড় হাফেজ-জী হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। হেদায়াতুন নাহু তথা মারফুয়াতের অধ্যায় পর্যন্ত পড়াশুনা করেন; হাতের লেখা খুবই সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ছাপা অক্ষরের মতই ছিলো। কুরআনুল করিমের ৩০ পারা হিফজ করার পর গ্রামের শিশু কিশোরদের শিক্ষাদানে নিয়োজিত হন। একদিন তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় সন্তানতুল্য স্নেহাশীষ খলিফা; সাত তরীকার ইমাম সাইয়্যিদ আবদুল বারী শাহ্ রহ. কে নিজগৃহে নিয়ে এসেন; অতপর স্বীয় পুত্র হজরত হাফেজ হামেদ হাসান রহ.’র সাথে পরিচয় করে দেন। অতপর উভয়ের সৌহার্দপূর্ণ আলাপচারিতায় মুগ্ধ হয়ে সাইয়্যিদ আবদুল বারী শাহ্ রহ’র হাতে হাফেজ হামেদ হাসান রহ. কে সোপর্দ করেন। সাইয়্যিদ সাহেব রহ. অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাঁর যোগ্যতা ও প্রতিভা অনুধাবন করে তাঁকে মণিমুক্তায় রূপান্তর করার মানসে প্রথম দায়রার তালিম সহকারে তাওয়াজ্জুহ ও নেসবত দিয়ে তাঁর অন্তরকে রূহানী সম্পদে পরিপ‚র্ণ করে তুলেন। এ দুর্লভ জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করতে তিনি সাইয়্যিদ সাহেব রহ.’র সাহচর্যে ও পাঠগ্রহণে উদ্ধুদ্ধ হয়ে আধ্যাত্মিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। বলা বাহুল্য যে, রূহানী জ্ঞান এমন একটি জ্ঞান, যা হাটবাজারে টাকায় কেনা পাওয়া যায় না, গ্রন্থাগারের হাজারোও বইপুস্তকে পাওয়া যায় না! এমনকী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। এ জ্ঞান অত্যন্ত দুর্লভ ও অদৃষ্টপূর্ব। ইনসানে কামেলের কাছে এ জ্ঞান পাওয়া যায়। তাঁদের সিনা-ব-সিনা তাওয়াজ্জুহ ও নেছবতের মাধ্যমে এ জ্ঞান অন্তস্থ হয়। এ জ্ঞানের সংযোগস্থল সরাসরি হজরত মুহাম্মদ দ.’র সাথে সম্পৃক্ত। সাংসারিক দুরবস্থায় বিচলিত না হয়ে আল্লাহর শোকর গুজারী হয়ে পার্থিব ও ধর্মীয় দায়দায়িত্ব প‚র্ণোদ্যমে পালন করতেন; এমনকী স্বহস্তে কৃষিকার্য সম্পন্ন করতেন। পীর ও পীরের ছেলের স্বহস্তে চাষাবাদের মত পরিশ্রমের দৃশ্য দেখে লোকজন হাসাহাসি করত! মাঠের বাইরে থাকাকালীন, ছাত্ররা তাঁর সাথে যেত এবং তিনি পড়াতে থাকতেন। তিনি দুপুরের খাবার, জুহরের নামাজ, মুরাক্বাবা ও কোরআন তেলাওয়াত এবং তাওয়াজ্জুহ প্রদানের জন্য বিকালে বিরতি নিতেন। কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর আবার মাঠে ফিরতেন। তাঁর জীবনধারা ছিলো সুশৃঙ্খল ও বৈচিত্র্যময়। নামাজ, দরুদ শরীফ, কুরআন তেলাওয়াত ও ছাত্রদের পাঠদান এবং মোরাকাবা-মোশাহাদা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতেন। সময়সাপেক্ষে তাওয়াজ্জুহের সময়স‚চী ও মোরাকাবার সময়কাল পরিবর্তিত হতো। উল্লেখ্য যে, হজরত সাইয়্যিদ আবদুল বারী শাহ্ রহ.’র প্রথম স্বাক্ষাতের পরক্ষণ হতে তিনি কঠিন সাধনার মাধ্যমে ইলমে বেলায়াতের স্তরগুলো ক্রমান্বয়ে হাসিল করতে লাগলেন; এজন্য তাঁর জিকির ও জজবার হাল ছিলো অবর্ণনীয় ও অকল্পনীয় যা আল্লাহর রহমতের স্রোতধারায় বেষ্টিত ছিলো। হালতের আম‚ল পরিবর্তনে ফানা ফিল অজুদের মাকাম হাসিল করে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিত হওয়ার সাধনায় নিমগ্ন হন। এজন্য আল্লাহ তা’লা সুরা বাকারার ১৩৮ নং আয়াতে বলেন, তোমরা আল্লাহর রঙে রঙিন হয়ে যাও। অনুরূপে হাদিস শরীফে রাসূল দ. উম্মতদের আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন। ফানা ফিল অজুদের পাশাপাশি ফানা ফিশ শায়খের মাকাম তথা পীরের হুকুমের প্রতি আনুগত্য এ স্তরটি হাসিল করেন। এরপর আবারও সাইয়্যিদ সাহেব রহ. বিশদভাবে দ্বিতীয় দায়রা পর্যন্ত তালীম প্রদান করেন। এ দায়রা গুলো সফলতার সাথে সম্পন্ন করে শরীয়ত,তরিক্বত,মারেফাত ও হাকিকতের নির্যাস জ্ঞান লাভ করেন। এরই মধ্যে জীবন জীবিকার দায়ে সম্ভাব্য ১৯০১ সালে বার্মায় সফর করেন। সেখানে শিক্ষকতার পেশায় যোগদান করেন। তাঁর কাছে একদিন চিঠি আসলো, পীর সাহেব অত্যধিক অসুস্থতায় ভুগছেন; এমনকি শরীরে গুটি বসন্ত দেখা দিয়েছে! সংবাদ শুনে তাৎক্ষণিক চাকরী থেকে ইস্তেফা নিয়ে স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন; পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই পীর সাহেব ইন্তেকাল করেন। পীর সাহেব ইন্তেকালের পূর্বে উপস্থিত মজলিসের সামনে তাঁকে তরীকতের খেলাফতের দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন । এ সংবাদ জানিয়েছেন নজিবুন বুয়া রহ.। এ দায়িত্বের কথা শুনে বিস্মিতচিত্তে তিনি বলেন, আমি তো নতুন! ইহা কেমনে হবে? প্রতিত্তুরে নজিবুন বুয়া রহ. বলেন, এ বিষয়ে আমিও হজরত সাইয়্যিদ সাহেব রহ. কে অবগত করেছিলাম। সাইয়্যিদ সাহেব রহ. প্রতিত্তুরে বলেছিলেন, “আমি তো আছি”(অর্থাৎ তরীক্বতের কাজ করতে যেখানে অসুবিধা হবে সেখানে আমি সাহায্য করবো)। তারপর থেকেই এ দায়িত্ব পালনে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তবে পীর হারানোর বেদনায় ব্যাকুল হয়ে দাদাপীর হজরত মাওলানা গোলাম সালমানী রহ.’র সাহচর্য লাভ করেন কিছুদিন যার পীর হলেন হজরত ফাতেহ আলী ওয়াইসী আল-বর্ধমানী রহ.। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, “সাইয়্যিদ সাহেব রহ. ই তাঁর জন্য যথেষ্ট; অন্য কারো দ্বারস্থ হওয়া নিষ্প্রয়োজন।” হজরত সালমানী রহ. তাঁকে এবং তাঁর সিলসিলার মুরিদানদের অত্যধিক মুহাব্বত করতেন; যার প্রমাণ এ উক্তিটি, “আপনার ও আপনার মুরিদের জন্য আমার দ্বার সর্বদা উম্মুক্ত।” হজরত সালমানী রহ. দুনিয়া তালাশকারীদের চেয়ে আল্লাহ তালাশকারীদের বেশি গুরুত্ব দিতেন; এজন্য তিনি বলতেন, “আমি একজন তারেকুদ দুনিয়া নির্জনবাসী ফকির, দুনিয়া ও দুনিয়াদার লোকের সাথে আমার কী প্রয়োজন? কেউ আসে মামলা মোকাদ্দমার দোয়ার জন্য; আবার কেউ আসে সন্তানসন্ততি চাইতে।” উচুঁ মানের এ আধ্যাত্মিক কথা শুনে তাঁর অন্তরে অস্থিরতা বিরাজ করতে লাগল! এ অস্থিরতা ছিলো আল্লাহর সান্নিধ্যের জন্য। দুনিয়ার টাকাকড়ি, ক্ষমতা ও যশখ্যাতির জন্য নয়। সর্বপ্রথম তরীকত প্রচারের সফর করেন চট্টগ্রামে; যদিও সফরের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা হজরত আবু হামেদ মিয়া করিম বকস্ রহ.। তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার মুরিদরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সাদরে গ্রহণ করলেন। তাঁদের আন্তরিকতায় ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে; কিছুদিন অবস্থান করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দ্বিতীয় বার সফরে তাঁর জ্যোতির্ময় হালতে রাত জেগে যিকির ও নামাজ আদায় দেখে অনেকেই তাঁর কাছে তরীকতের তালিম নেন এবং তালিবদের আত্মোৎকর্ষিত অবস্থা দেখে সকলেই বিস্মিত হন! দাদাপীর হজরত সালমানী রহ.’র নির্দেশক্রমে বছরে ৩/৪ মাস তরীকত প্রচারের সফর করতেন। তৎমধ্যে প‚র্ব বাংলা আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, আরাকান, বিশাল ভারতের এলাহাবাদ, পূর্ণিয়া ভুপাল, করাচি, মুম্বাই ইত্যাদি অঞ্চল সফর করতেন। আয়না-ই-মুনির রহ. বইয়ের এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, হজরত আজমগড়ী রহ. চট্টগ্রামে তাবলীগে আসলে প্রথমে হালিশহর দরবারে আসতেন এমনকি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময়ও। উল্লেখ্য যে, হালিশহর দরবারের পীর হজরত হাফেজ সাইয়্যিদ মুনির উদ্দীন নুরুল্লাহ রহ. কে হজরত হাফেজ হামেদ হাসান রহ. ১৯১৪/১৫ সালের দিকে সাত তরিকার খেলাফত বখশিশ করেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের বদৌলতে আল্লাহ পাক তাঁর তরীকতের বাগান কে জান্নাতের বাগানে রূপদান করেন। এ মকবুল তরীকার সিলসিলার মধ্যদিয়ে হাজারও পীর-আউলিয়া জন্ম নিয়েছেন। যাদের শিক্ষাদানে হাজারোও গোমরাহি ও রুগ্ন কলবদারি আল্লাহর সান্নিধ্যে ধন্য হয়েছেন। আধ্যাত্ম পরিমন্ডলের জ্যোতিষ্ক এ মহান আত্মিক শুদ্ধ পুরুষ ৪৪ জন খলিফা রেখে যান। তৎমধ্যে ১৫ জনই চট্টগ্রামের। যাঁরা হলেন, চুনতির মাওলানা নজির আহমদ রহ, হালিশহরের হাফেজ সাইয়্যেদ মুনিরুদ্দীন নুরুল্লাহ রহ., বোয়ালখালীর মাওলানা আবদুল জব্বার রহ., বাঁশখালীর মাওলানা খলিল আহমদ/খলিলুর রহমান রহ., চুনতির মাওলানা ফজলুল হক রহ., সাতকানিয়ার মাওলানা ফজলুর রহমান রহ., আনোয়ারা জুঁইদন্ডীর মাওলানা শরফুদ্দীন চিশতি রহ., কুতুবদিয়ার মাওলানা জামাল উদ্দীন রহ., চুনতির হাকিম মাওলানা কাজী মুনির আহমদ রহ.,গারাংগিয়ার মাওলানা আবদুল মজিদ রহ, গারাংগিয়ার মাওলানা আবদুর রশিদ সিদ্দিকী রহ., সাতকানিয়ার মাওলানা আবদুল মাবুদ রহ., দোহাজারীর মাওলানা আবদুল হাকিম রহ., সাতকানিয়ার মাওলানা আকামুদ্দীন রহ., লোহাগড়ার মাওলানা অজীহুল্লাহ রহ.। তাঁর অন্তর খাওফে ইলাহী ও হুব্বে মুস্তফায় ভরপুর থাকত সবসময়। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিলো অণুবীক্ষণ যন্ত্রের চেয়েও সূক্ষ্ম। কারণ আল্লাহর অলিগণ আল্লাহর ন‚র দিয়ে সবকিছু অবলোকন করেন। তিনি ১৯৫৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ১৭ রবিউল আউয়াল মাসে আল্লাহর দিদার লাভ করেন এবং ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে তাঁকে শায়িত করা হয়। এ রূহানী কর্মযজ্ঞের প্রবাহমান স্রোতধারা যুগযুগ ধরে চলমান থাকুক এটি হোক সকলের প্রার্থনা।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আলহামদুলিল্লাহ অত্যন্ত ভালো একটি কাজে থাকতে পেরে খুবই ভালো লাগছে ০৫/০৪/২০২৪ শুক্রবার বিকাল ৩ ঘটিকায় কাতার চ্যারিটির পক্ষ থেকে ৫০০ পরিবারের মাঝে ঈদ সামগ্রী প্রদান উপহার প্রদান করেন ৬৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জনাব আব্দুল মতিন সাউদ ভাই ও ফুলকুড়ি ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন ভাই ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সকলেই ছিলেন পাশাপাশি সার্বিক সহযোগিতায়‌ ছিলেন এলাকার সকল ছোট ভাইয়েরা। এবং এই ঈদ সামগ্রীর আয়োজক ছিলেন আমজাদ হোসেন বাবলু ভাই এডমিন কাতার চ্যারিটি

পাঁচ শতাধিক পরিবার কে ঈদ উপহার দিলো কাতার চ্যারিটি