শাহ্ সূফী আলহাজ্ব মাওলানা নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী (রহ.)’র জীবন ও অবদান

কাউছার উদ্দীন আল মালেকী
  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০২৩
  • ৪৭৫ Time View

সূফী দরবেশ ও পীর-আউলিয়ার পদচারণায় মুখরিত এ চট্টগ্রামেরই সূর্য সন্তান গাজীয়ে বালাকোট, শায়খুত তরীক্বত, আলহাজ্ব মাওলানা শাহ্ সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী (রহ.)। মর্দে মুজাহিদ হিসেবে যার পরিচিতি সারা বিশ্বব্যাপী। এ বীর মুজাহিদ অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষকে কে শাণিত তরবারির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে পরাভূত করতেন। তিনি আজ শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন, বাংলার জনপদ মীরসরাই মিঠানালা ইউনিয়নে। এ জগতখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন, ইসলামী শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা ও উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক, হজরত আলহাজ্ব সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)’র স্নেহধন্য খলিফা। তিনি বালাকোট যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে গাজীয়ে বালাকোট উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর জন্মসাল নিয়ে মতপার্থক্য আছে তবে জন্মস্থান নিয়ে নয়। তিনি সম্ভাব্য ১৭৯০ সালে নোয়াখালী জেলার ছান্দিরা/দান্দীরা গ্রামের হজরত মাওলানা শেখ ফানাহ (রহ.)’র ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। এ আধ্যাত্মিক সূফীসাধক একাধারে ধর্মতত্ত্ববিদ, রাজনীতিবিদ, হাদীস বিশারদ ও আরবীবীদ সহ বহুগুণে গুণান্বিত ছিলেন। তিনি শরীয়াত ও তরীক্বতের জ্ঞানের ধারক ও বাহক ছিলেন। আল্লাহ প্রদত্ব বিশেষ জ্ঞান তথা বেলায়াতের জ্ঞানে ভরপুর ছিলো তাঁর প্রশস্ত অন্তর। তিনি ভারতের কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে অধ্যায়ন শেষ করে ফখরুল মুহাদ্দিসীন উপাধিতে ভূষিত হন। প্রখ্যাত লিখক আল্লামা নূর মোহাম্মদ আজমী (রহ.)’র “বঙ্গে এলমে হাদীস” গ্রন্থের ১৯৬৬ ইং ছাপার ২৬৬ পৃষ্ঠায় হজরত নিজামপুরী (রহ.) কে চট্টগ্রামের মুহাদ্দেসীনে কেরামদের তালিকা ভূক্ত করেছেন। খোদাভীরুতা ও পরহেজগারীতা ছিলো তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্যতার অন্যতম নিদর্শন। কুরআন ও হাদিস অনুসৃত পথ ও মতের উপর অটল থেকে সত্য ও ন্যায়ের পথে জীবনপাত করতেন সবসময়। অল্পেই তুষ্ট থেকে সৎভাবে জীবনযাপন করতেন এমনকী হালাল উপার্জন ছাড়া আহারও করতেন না। সন্দিহান বিষয় হতে নিজকে বিরত রাখতেন সদা। আল্লাহর জিকির ও দরুদে মোস্তফায় অবিশ্রান্ত থাকতো তাঁর জবান ও ক্বলব। এক ওয়াক্ত নামাজ শেষ করে অন্য ওয়াক্ত নামাজের জন্য অপেক্ষমাণ থাকতেন। সালাতুল ফজর আদায় করে সালাতুল ইশরাক পর্যন্ত জিকিরুল্লাহ ও মুরাক্বাবার ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। সালাতুল জোহর থেকে সালাতুল আসর পর্যন্ত কুরআন-হাদিস ও ইলমে তাসাউফের কিতাবাদি অধ্যায়ন করতেন এবং সালাতুল এশার পর তরীক্বতের অজীফা ও মুরাক্বাবা-মুশাহাদা করতেন। তিনি সুন্নাতে রাসূল (দ.)’র প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। তিনি অসুস্থ রোগীদের দেখাশুনা ও সেবা-শুশ্রূষা করতেন এবং মৃতব্যক্তির নামাজে জানায় শরীক হওয়া নিজের জন্য আবশ্যকীয় মনে করতেন। নিজহাতে অন্যের কাজ করে দিতেন স্বতঃস্ফূতভাবে। গরীব দুঃখী মানুষের পাশে থেকে সবসময় মানুষের কল্যাণে কাজ করতেন। পোশাকে-পরিচ্ছেদে ও চলায়-ফেরায় বিলাসিতা পরিহার করে অতিসাধারণ জীবনযাপন করতেন। মিতভাষী, মিষ্টিভাষী ও নম্রভাষী হয়ে সকলের সাথে বিনয়ী আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন। বিপদে, সংগ্রামে ও সংকটে আস্থা ও ভরসা রাখতেন এক আল্লাহর উপর যিনি এক ও অদ্বিতীয়। মানুষকে নীরবে নিভৃতে দান করতেন অকাতরে। জগৎবিখ্যাত হাদিস বিশারদ হওয়া সত্ত্বেও তরীক্বতের জ্ঞান অর্জনের জন্য একজন শায়খের সন্ধানে ছিলেন। তাঁর তরীক্বতের শায়খ বা পীর নিয়ে তিনটি বর্ণনা পাওয়া যায়, হজরত মাওলানা শেখ জামাল রহ. এবং আজিমপুর দায়রা শরীফের গদিনশিন সূফী সায়্যিদ লাক্বীত উল্লাহ (রহ.) । বিশুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে, তাঁর পীরও মুর্শিদ হচ্ছেন, হজরত সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরলভী রহ.। এ বিষয়ে ইতিহাসবিদগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন এবং বিভিন্ন বই পুস্তকে ও এ মতটি গ্রহণ করেছেন। সাইয়্যিদ সাহেব (রহ.) ছিলেন নবী করিম (সা.)’র বাগানের সুভাষিত ফুল। যে ফুলের সুভাষ সারা পৃথিবীকে সুভাষিত করেছে। গোলাম রসূল মেহেরের লিখিত বই “সৈয়দ আহমদ শহীদ” শিরোনামের বইয়ে ২১৬ পৃষ্ঠার বর্ণনায় এসেছে, নবী করিম(দ.) মাওলানা নিজামপুরী (রহ.) কে স্বপ্নে সুসংবাদ দিয়ে জানিয়েছেন, আমার ছেলে সৈয়দ আহমদ এসেছেন (কলকাতায়)। তুমি তার হাতে বায়াত গ্রহণ করো। অতঃপর সূফী নূর মোহাম্মদ সাহেব তাড়াতাড়ি কলকাতা এসে সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরলভী (রঃ)’র হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং ১৮২১-১৮৩১ এই দশ বছর মুরশিদের সরাসরি ছোহবতে ও খেদমতে ছিলেন। ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুলাই, ১২৩৬ হিজরী সনের ২০ শাওয়াল ৪৩০ জন সঙ্গীসহ সায়্যিদ সাহেব (রহ.) কলকাতা থেকে হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহ শরীফ রওয়ানা হন। পথিমধ্যে আরো ৭০০ জন এই মুবারক কাফেলায় যুক্ত হয়। পবিত্র হজ্বে অন্যতম সফর সঙ্গী হিসেবে ছিলেন তিনি। হজরত সাইয়্যিদ সাহেব (রহ.) এবং তাঁর সুগভীর রূহানী সম্পর্ক ছিলো। জিহাদের সফরে সায়্যিদ সাহেব (রহ.)’র তাবুর সন্নিকটেই নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.)’র কামরা থাকত! শাহ্ সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহ.), মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ.) ও নোয়াখালীর মাওলানা গাজী ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী সাদুল্লাপুরী (রহ.) তিন জনই ছিলেন পীর ভাই। তাঁরা সকলেই শাহ্ সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরলভী (রহ.)’র মুরীদান ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকে মহব্বতের সঙ্গে আল্লাহর ওয়াস্তে পীরের খেদমত করতেন। একনিষ্টতা ও আন্তরিকতা দিয়ে নিজামপুরী (রহ.) পীরের খেদমত করতেন। নিজামপুরীর খেদমতে খুশি হয়ে সাইয়্যিদ সাহেব (রহ.) দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ! আপনি নূর মুহাম্মদ এর পরকালের ঘরকে (কবরকে) খুশবুতে ভরপুরে রাখুন।” আল্লাহ পাক তাঁর এ দোয়া মঞ্জুর করলেন। নিজামপুরী (রহ.)’র মাজারে আজো খুশবু মাখা ঘ্রাণ পাওয়া যায়। বায়আত গ্রহণের পরেই তিনি পীরের নির্দেশে রিয়াযতে নিমগ্ন হন। সাইয়্যিদ সাহেব (রহ.)’র  তালীম ও তাওয়াজ্জুহের ফলে তরীক্বতের ছবকগুলো দ্রুত পালনের মধ্যদিয়ে বেলায়াতের উচ্চাঙ্গ পৌঁছান এবং খেলাফত লাভ করেন। পীর ও মুরশিদ কর্তৃক দ্বীন ও তরীকা প্রচার এবং সালিকদের মধ্যে ফয়েজ প্রদানের নির্দেশ প্রাপ্ত হন তিনি। বর্ণনায় এসেছে, ঐসময় প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ জন বিধর্মী মুসলমান হতো সাইয়্যিদ সাহেব (রহ.)’র হাতে। মাখযানে আহমদীর লেখক বলেন, ঐ সময় জনসমাজে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, “দেখলে তুমি বলতে এ যেন নবীর যুগ পুনর্জীবন লাভ করেছে।” তরীকতের বায়আতের পাশাপাশি সূফী নূর মুহাম্মদ তাঁর পীর মুরশিদ সাইয়্যিদ সাহেব (রহ.)’র কাছে জিহাদেরও বায়আত গ্রহণ করেন। ১৮২৬ -১৮৩১ পর্যন্ত প্রায় ১৮টি ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। যেমন, আকুড়ার যুদ্ধ, নওশাহের যুদ্ধ, পাঞ্জতারের যুদ্ধ, মায়দার যুদ্ধ, শায়দুর যুদ্ধ, হাজারার যুদ্ধ, মাইয়ার যুদ্ধ ও ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধ। এছাড়া ফুলেড়া অভিযান, পেশোয়ার অভিযান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মায়দার যুদ্ধে শত্রুপক্ষ কামানের গোলা ছুঁড়তে শুরু করলে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে তখন সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী (র.) হাকীকতে মাকামে সাইফুল্লাহর ফয়েজ প্রয়োগ করেন; ফলে নিজেদের সৈন্য রক্ষা ও শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার প্রথম পদক্ষেপে সফল হয়। এমনকি তিনি তাঁর নিজ হাত মুবারক দিয়ে কামানের গোলা হস্তগত করে অকার্যকর করে দেন; যার ফলশ্রুতিতে যুদ্ধে জয়লাভ করে মুজাহিদ বাহিনী বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, কামান, গোলা, বারুদ ইত্যাদি হস্তগত হয়। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে মাইয়ার যুদ্ধে ফজলুর রহমান বর্ধমানী শহীদ হন এবং মাওলানা আব্দুল হাকীম বাঙ্গালী ও সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.) প্রমুখ আঘাতপ্রাপ্ত হন। নওশাহের যুদ্ধে সূফী নূর মুহাম্মদ অন্যতম সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিপক্ষের সহস্রাধিক সৈন্যের মোকাবেলা করেন। অসীম বীরত্ব ও সঠিক নেতৃত্ব সর্বোপরি আল্লাহ তা’লার অদৃশ্য সাহায্যে মুসলমানগণ উক্ত যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এ সকল জিহাদে নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন, যুদ্ধের পূর্বে তিনি একটা রুমাল ঘুরিয়ে সেনাবাহিনীর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করতেন এবং শত্রুপক্ষের তীর, বর্শা ইত্যাদি বিসমিল্লাহ বলে হাত দিয়ে ধরে ফেলতেন। অগণিত তীর, বর্শা ও বল্লমের আঘাতে তাঁর একহাত অবশ হয়ে গেলেও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন নি। রণজিৎ সিং এর বাহিনীর সাথে এক যুদ্ধের প্রাক্কালে রণজিতের প্রাসাদের অদূরে আমীরুল মুমিনীন সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) তাঁর মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে তাঁবু স্থাপন করেন। নামাযের সময় হলে তিনি ঘোষণা দেন, “আজ ঐ ব্যক্তি আযান দিবেন যার (দীর্ঘ সময় উল্লেখপূর্বক) আসরের সুন্নাত নামায ছুটে যায়নি।” সেদিন সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী আযান দেন। বর্ণনায় এসেছে, তাঁর আযানের সাথে সাথে রণজিত সিং এর রাজমুকুট খসে পড়ে এবং ঝড় শুরু হয়। ১২৪৬ হিজরীর ২৪ জিলকদ জুমাবার ৬ ই মে ১৮৩১ ইং সালে ঐতিহাসিক বালাকোট প্রান্তরে ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধকে ঐতিহাসিকগণ দ্বিতীয় কারবালা নামে আখ্যা দিয়েছেন। এই যুদ্ধে সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরীর ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। এ যুদ্ধে মুসলমান মুজাহিদ ছিলো ৩০০ জন এবং শিখদের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। অপর্যাপ্ত রসদ ও প্রায় অস্ত্রবিহীন তিনশত মুসলিম মুজাহিদ বাহিনী বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ২০ হাজার শিখ সৈন্যকে বালাকোট প্রান্তর থেকে প্রায় ছয় মাইল দূরে হটিয়ে দেয়। কিন্তু কিছু পাঠানের বিশ্বাসঘাতকতায় অতর্কিত হামলায় মুজাহিদ বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে আমিরুল মুহাজিদিন,আওলাদে রাসূল (দ.), তরীক্বায়ে মুহাম্মদির প্রবর্তক, দ্বীনের পুনর্জাগরণকারী ও আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, হজরত সায়্যিদ শহীদ আহমদ বেরলভী (রহ.) ও তাঁর খলিফা নায়েবুল মুহাজিদিন হজরত শাহ্ ইসমাইল (রহ.) ও সায়্যিদ ওয়ারেস আলী রহ. প্রমুখ শাহাদাত বরণ করেন। “মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত। যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।” কাজী নজরুল ইসলাম। এমন সঙ্কটকালে সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর ঈমানদীপ্ত ভাষণে মুজাহিদ বাহিনীর মনোবল ফিরে আসে। অতঃপর দুর্বারগতিতে যুদ্ধ চলতে থাকে। নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী একাই প্রায় দুই হাজার শিখকে হতাহত করেন। তাঁর মুবারক হাঁটুতে একটি গুলি বিদ্ধ হয়ে বের হয়ে যায় কিন্তু তাঁর কোন অনুভূতিই ছিল না, হাঁটু দিয়ে যখন অঝোর ধারায় রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল এবং সেই রক্তে কাপড় রঞ্জিত হয়ে গেলে অনুভব করতে পারলেন। অনাহারে বিরামহীন যুদ্ধ করার কারণে ক্রমশ দুর্বল হলেও যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে যাননি। এক পর্যায়ে সারা শরীরে জখম ও রক্ত প্রবাহিত হতে থাকলে হজরত নিজামপুরী (রহ.) তরবারি ছেড়ে দিয়ে কবিতাংশ আবৃত্তি করে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানান, “বরছুরম আমদওলে বিছিয়ার জোদ আজমন গুনদাসত, দৌলাত তেজী কেমীন গৌইয়ান্দ শমশির তাবুয়াদ।” অর্থাৎ “হে আমার রব! আমার মাথার উপর অনেক তীর তরবারি এসে পড়েছে কিন্তু তাতে আমার কোনো খবরই ছিল না বরং তরবারি আমাকে ঐশী প্রেরণা দেয় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। কিন্তু আমি যে হীন দুর্বল হয়ে পড়েছি। আর যুদ্ধ করতে পারছি না।” বালাকোট যুদ্ধে এই বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি ‘গাজীয়ে বালাকোট’ খেতাব প্রাপ্ত হন। বস্তুতঃ ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারাবালাকি বাদ। অর্থাৎ ইসলাম জিন্দা হয় প্রতিটি কারবালার পরে। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, কোনো কুরবানিই বৃথা যায় না। অনুরূপে হজরত সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরলভী (রহ.) সহ অসংখ্য মুজাহিদ প্রাণ দিয়ে এ উপমহাদেশে ইসলাম কে পুনর্জীবিত করেছেন এবং এ উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামের মহাজাগরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা জীবন দিয়েছে তবু ঈমান দেননি। এটি ইসলামের শিক্ষা। অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর” কাজী নজরুল ইসলাম। এ মহান সংগ্রামী সাধক পুরুষগণ চাইলে, মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা ও পীর-মুরিদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমোদ প্রমোদে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারতেন। অথচ তাঁরা সারা জীবন মানুষকে হেদায়াতের পথে ডেকেছেন এবং ইসলামের স্বার্থে জান-মাল বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। তাঁদের এক হাতে ছিল তসবিহ আরেক হাতে রাঙ্গা তলোয়ার; মুখে ছিলো আল্লাহর জিকির এটি ছিলো তাঁদের জীবনচরিত। নিজামপুরী (রহ.) মনে করতেন, সংসারে সময় করার চেয়ে দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগে সময় ব্যয় করা উত্তম। এজন্য তিনি স্ত্রী পর্যন্ত গ্রহণ করেননি। মানুষের সমস্যা সমাধান করা বড় কোন কারামত নয়। মানুষকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া তথা জাহান্নামী কে জান্নাতী হিসেবে গড়ে তোলাই হলো বড় কারামত। যা তাঁর জীবনে দৃশ্যমান ঘটনাপ্রবাহ গুলো সাক্ষ্য দেয়। এছাড়া তাঁর থেকে অসংখ্য ও অগণিত কারামত প্রকাশিত হয়েছে। বর্ণনায় এসেছে যে, তাঁকে গ্রেপ্তার ও প্রাণনাশ করার জন্য বহুবার বহুজায়গায় চারিদিকে ইংরেজ সৈনিকরা ঘিরে রেখেছেন। অথচ সেখান হতে তৎক্ষনাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতেন। এটি ছিলো তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি প্রয়োগের ক্ষুদ্রাংশ বিশেষ “কারামাত”। হজরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)’র তরীক্বতের ক্রমধারা প্রাচ্য হতে পাশ্চাত্য ছড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে, ফুরফুরা দরবার শরীফ, ফুলতলী দরবার শরীফ, ছারছিনা দরবার শরীফ, সোনাকান্দা দারুল হুদা দরবার শরীফ, বিশ্ব শান্তি মঞ্জিল এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফ, চন্দ্রপাড়া পাক দরবার শরীফ, হালিশহর দরবার শরীফ (পীর হাফিজ ছৈয়দ মুনিরুদ্দীন নুরুল্লাহ রহ.), চট্টগ্রামের গারাংগিয়া দরবার শরীফ, কুতুব শরীফ দরবার, কাগতিয়া দরবার শরীফ সহ অসংখ্য অগণিত তরীক্বতের জংশন বিস্তৃত রয়েছে। যাদের পরশে হাজারো বিপদগামী মানুষ সত্যের সন্ধান তথা হেদায়াত পেয়েছে এবং গড়ে উঠেছে হাজারো মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা,এতিমখানা, মক্তব, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদালয় সহ অসংখ্য দাতব্য ও প্রশিক্ষণ মূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পীর-মুরিদী ও মাজার কেন্দ্রীক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির ঘোর বিরোধী ছিলেন হজরত নিজামপুরী (রহ.)। যার প্রমাণ তাঁর ইন্তেকালের পূর্বের অছিয়ত নামা “আমার কবরের উপর ঘর বা গম্বুজ করিওনা। আমার কবর নিয়ে অযথা ব্যয় করিও না। আমার কবরকে কেন্দ্র করে শরীয়ত বিরোধী কোন অনুষ্ঠান করিও না।” ইসলামের এ অতন্দ্র প্রহরী হাজারো ভক্ত মুরিদান রেখে ১৮৫৮ ইংরেজীর পহেলা নভেম্বর, ২৪ই রবিউল আউয়াল, ১২৭৫ হিজরীর, ১২৬৬ বাংলার ১৩ই কার্তিক শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিওন। প্রার্থনা, হে আল্লাহ! আপনার নেয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পথে ও মতে জীবন গড়ার তৌফিক দান করুন।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

আলহামদুলিল্লাহ অত্যন্ত ভালো একটি কাজে থাকতে পেরে খুবই ভালো লাগছে ০৫/০৪/২০২৪ শুক্রবার বিকাল ৩ ঘটিকায় কাতার চ্যারিটির পক্ষ থেকে ৫০০ পরিবারের মাঝে ঈদ সামগ্রী প্রদান উপহার প্রদান করেন ৬৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জনাব আব্দুল মতিন সাউদ ভাই ও ফুলকুড়ি ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন ভাই ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সকলেই ছিলেন পাশাপাশি সার্বিক সহযোগিতায়‌ ছিলেন এলাকার সকল ছোট ভাইয়েরা। এবং এই ঈদ সামগ্রীর আয়োজক ছিলেন আমজাদ হোসেন বাবলু ভাই এডমিন কাতার চ্যারিটি

পাঁচ শতাধিক পরিবার কে ঈদ উপহার দিলো কাতার চ্যারিটি